প্রথম অধ্যায়:
প্রথম আলো
প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের সবকিছু যেন এক নতুন রঙে রঙিন হয়ে উঠল। পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন পৃথিবীর বুকে পড়ল, তখন তার ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙল সবুজ বনভূমির। পাখিরা নিজেদের ডানা মেলে ধরল, গাছের পাতায় নরম কিরণ এসে পড়ল, আর ছোট্ট প্রাণীরা তাদের দিন শুরু করতে ছুটে চলল এখানে-সেখানে। সেই রশ্মি এসে পড়ল রাকা নামের এক ছোট্ট ছেলের চোখে, যে তার জানালার পাশেই বসে ছিল।
রাকা খুবই কৌতূহলী প্রকৃতির ছেলে। প্রতিদিন সকালে সে তার জানালার পাশ থেকে সূর্যোদয় দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু আজকের দিনটা ছিল অন্যরকম। রাকা লক্ষ্য করল, আজকের সূর্যের আলোটা যেন অন্যদিনের থেকে একটু বেশি উজ্জ্বল। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, চারপাশে সবকিছু যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গাছগুলো আরও সবুজ, ফুলগুলো আরও রঙিন, আর আকাশটা যেন আরও নীল হয়ে উঠেছে।
রাকা ভাবল, এই আলোটা কি শুধুই আলো, নাকি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো বিশেষ মায়া? সে তার মা’কে জিজ্ঞেস করল, "মা, আজকের আলোটা এত সুন্দর কেন?"
তার মা মৃদু হেসে বললেন, "সূর্যদেব আজ খুব খুশি হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। হয়তো তোমার জন্যই আজকের সকালটা এত উজ্জ্বল।"
রাকা মায়ের কথায় মুগ্ধ হলো, কিন্তু তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। সে ভাবল, "যদি সূর্যদেবের কাছে গিয়ে জানতে পারতাম, কেন আজকের আলো এত বিশেষ।"
এই ভেবে রাকা সিদ্ধান্ত নিল, সে সূর্যদেবের রাজ্যে যাবে। সে জানত এটা কোনো সাধারণ যাত্রা নয়, তবে তার মনে ছিল প্রচণ্ড সাহস। সে তার ছোট্ট ব্যাগে কিছু খাবার, একটি বোতল পানি, এবং তার প্রিয় খেলনাটি নিলো। মা তাকে বিদায় দিলেন, মায়ের চোখে একটা ছোট্ট উদ্বেগের রেখা থাকলেও, মায়ের মুখে ছিল রাকার সাহসিকতার জন্য গর্ব।
রাকা প্রথমে বনের দিকে রওনা দিল। বনের মধ্যে ঢুকে সে দেখতে পেল, সবকিছু যেন আলোর এক আশ্চর্য খেলায় মেতে উঠেছে। সূর্যের কিরণ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসছে, আর পাতার ছায়া নিচে পড়ে তৈরি করছে রঙিন ছায়াছবি। পাখিরা গান গাইছে, আর ছোট ছোট প্রাণীরা তাদের নিজের মতো করে ব্যস্ত।
হাঁটতে হাঁটতে রাকা এক জায়গায় থামল, যেখানে এক ছোট্ট নদী তার পথ অতিক্রম করছিল। নদীর জলে সূর্যের আলো পড়ে তৈরি করছিল সোনালী ঝলকানি। রাকা নদীর ধারে বসে একটু বিশ্রাম নিলো, তারপর সে নদীর পানিতে হাত ডুবিয়ে সেই সোনালী ঝলকানির ছোঁয়া অনুভব করল।
সেখানে একটা ছোট্ট মাছ রাকার হাতের কাছে এসে দাঁড়ালো। মাছটি বলল, "তুমি সূর্যদেবের রাজ্যে যাচ্ছো, তাই না?"
রাকা অবাক হয়ে মাছটির দিকে তাকালো, "তুমি কিভাবে জানলে?"
মাছটি মুচকি হেসে বলল, "সূর্যদেব আমাদের সকলকে জানিয়েছেন যে, তুমি আসছো। তিনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"
রাকা মাছটির কথা শুনে খুশি হলো, কিন্তু তার মধ্যে একটু ভয়ও কাজ করছিল। সূর্যদেবের সাথে দেখা হবে, এটা তো কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।
মাছটি তাকে বলল, "ভয় পেয়ো না। সূর্যদেব খুবই দয়ালু। তুমি যখন তার কাছে পৌঁছাবে, তিনি তোমাকে স্বাগত জানাবেন।"
রাকা মাছটির কথায় সান্ত্বনা পেল। সে নদী পার হয়ে আরও দূরে চলল। বন থেকে বের হয়ে সে একটি উঁচু পাহাড়ের কাছে পৌঁছাল। এই পাহাড়টাই ছিল সূর্যদেবের রাজ্যে যাওয়ার রাস্তা।
পাহাড়টা বেশ খাড়া ছিল, কিন্তু রাকা দৃঢ় মনোবলে উপরে উঠতে লাগল। পথে সে বেশ কয়েকটি রঙিন পাখি দেখতে পেল, যারা তার পাশে উড়তে উড়তে গান গাইছিল।
অবশেষে, অনেকটা সময় পরে, রাকা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাল। সেখানে পৌঁছে সে দেখতে পেল, সূর্যদেব তার জন্য অপেক্ষা করছেন। সূর্যদেবের মুখে এক প্রশান্তির হাসি, আর তার চারপাশে এক অপূর্ব আলোয় ভরা পরিবেশ।
রাকা কিছুটা সংকোচ নিয়ে সূর্যদেবের সামনে দাঁড়াল। সূর্যদেব মৃদু হাসলেন, এবং বললেন, "তোমার কৌতূহল তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, আমি জানি। তুমি জানতে চাচ্ছিলে কেন আজকের আলো এত উজ্জ্বল।"
রাকা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সূর্যদেব বললেন, "আজকের দিনটা বিশেষ কারণ তুমি এই জগতে নতুন আলো নিয়ে আসবে। তোমার মনে যে কৌতূহল আর সাহস, সেটাই তোমাকে আলাদা করে তোলে। এই আলো শুধু আমার নয়, এই আলো তোমার জন্য, এবং তোমার মাধ্যমে পৃথিবীর জন্য।"
রাকার চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল। সে বুঝতে পারল, আজকের আলো শুধু তার জন্যই নয়, পৃথিবীর সকলের জন্য একটা নতুন দিন, নতুন সম্ভাবনা আর নতুন আশার প্রতীক।
সূর্যদেব রাকার মাথায় হাত রেখে বললেন, "যাও, পৃথিবীকে তোমার আলো দিয়ে আলোকিত করো।"
রাকা আনন্দিত মনে সূর্যদেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। তার মনে এক নতুন উদ্যম, এক নতুন আলো। তার মনে হলো, এই আলোর উৎস আসলে তার ভেতরেই ছিল, শুধু সে নিজেই সেটা আগে বুঝতে পারেনি।
তবে এখন সে জানে, তার প্রতিটি দিন, প্রতিটি পদক্ষেপ হবে এই আলোর এক অংশ, যা সে তার চারপাশের সকলের সাথে ভাগাভাগি করবে।
এইভাবেই, প্রথম আলো ফুটে উঠল রাকার জীবনে, যা তাকে আর সবাইকে নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।